শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্য তাৎপর্য বাধা সমূহ ও প্রভাব গুলি লেখ pdf || Child Centered Education in Bengali pdf

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্য তাৎপর্য বাধা সমূহ ও প্রভাব গুলি লেখ pdf || Child Centered Education in Bengali pdf

Child Centered Education in Bengali pdf

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার অর্থ (Meaning of Child-centric Education):

শিক্ষা একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। এই শিক্ষা প্রক্রিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো-শিশুর জীবন পরিক্রমা। এই পরিক্রমা থেকেই গড়ে উঠেছে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা। আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানে শিশুশিক্ষার্থীর নিজস্ব সত্তা, যেমন- তার আগ্রহ, রুচি, দক্ষতা, ক্ষমতা, ইচ্ছা ইত্যাদি কে কেন্দ্র করে যে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাকে বলা হয় শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা। এই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে গড়ে উঠেছে শিক্ষার পাঠক্রম, পদ্ধতি, শিক্ষাধারা, শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনা। তাই সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি, যে শিক্ষাব্যবস্থায়- 1. শিক্ষার কেন্দ্রে শিশু অবস্থান করে, 2. শিক্ষার্থীর শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলি স্বাধীনভাবে গ্রহণ করতে পারে, 3. বহুমুখী পরিবেশে অভিযোজনের ক্ষমতা লাভ করতে পারে, 4. শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, প্রাক্ষোভিক, নৈতিক ও নান্দনিক গুণাবলী অর্জন করতে পারে; তাকে বলা হয় শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা

শিক্ষাবিজ্ঞানে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও এই শিক্ষার সূচনা অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এর জনক ছিলেন ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশো। তবে রুশোর পূর্বেও কুইন্টিলিয়ান, ইরাসমাস, কমেনিয়াস প্রমুখের শিক্ষাচিন্তায় এই শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষা ভাবনা দেখা গিয়েছিল। পরবর্তীকালে পেস্তালাৎসি, হার্বার্ট, ফ্রয়েবেল, ডিউই, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধিজি প্রমুখের প্রচেষ্টায় শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষা শক্তিশালী হয়।

শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষা কাকে বলে বা শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষার সংজ্ঞা (Definition of Child Centered Education)

যে শিক্ষা শিশুর চাহিদা, আগ্রহ, প্রবণতা, মনোযোগ, ক্ষমতা প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং সেই অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য, শিক্ষার পাঠক্রম, শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষকের ভূমিকা প্রভৃতি নির্ধারিত হয়, তাকে শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষা বলে (Child Centered Education)।

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা অনুযায়ী– শিক্ষার মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো শিশু বা শিক্ষার্থী। অর্থাৎ শিশুকে কেন্দ্র করে যে শিক্ষার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করা হয়ে থাকে, তাকে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা বলে। শিশুর বিকাশ সাধন করাই হলো শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য

বিশিষ্ট প্রকৃতিবাদী দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ রুশো(Rousseau) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মন্তব্য করেছেন- “শিশুকে একাকী থাকতে দাও, তাকে তথাকথিত সভ্য মানুষ হবার চেয়ে প্রাকৃতিক মানুষ হতে দাও। তাকে এক প্রাকৃতিক অবস্থা পেতে দাও। কৃত্রিম পরিবেশ যেন তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশকে বাধা দিতে না পারে”

রুশো(Rousseau) এ প্রসঙ্গে আরোও The Social Contact গ্ৰন্থে বলেছেন-“জন্ম মুহূর্তে মানুষ স্বাধীন, কিন্তু পরবর্তীকালে সে সর্বত্র শৃংখলে আবদ্ধ হয়”(Man is born free, but every where he is in chains)।

আবার, শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা সম্পর্কে পেস্তালৎসি (Pestalozzi) বলেছেন- “I wish psychologize Education”. অর্থাৎ আমি শিক্ষাকে মনোবিজ্ঞান সম্মত করতে চাই।

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি (Characteristics of Child Centric Education)

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার(Child Centered Education) মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো শিশু বা শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি পরিলক্ষিত হয় সেগুলি হল-

1. শিশুই প্রধান:- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল শিশুই প্রধান। অর্থাৎ এই শিক্ষার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে শিশু। শিশুর চাহিদা, আগ্রহ, প্রবণতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী এই শিক্ষা যাবতীয় আয়োজন করা হয়ে থাকে।

2. শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা:- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী গতানুগতিক শিক্ষার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে তার নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহ অনুসারে শিক্ষা গ্রহণ করার স্বাধীনতা পায়। এখানে থাকে না কোন বাহ্যিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ এবং বিধি নিষেধের চাপিয়ে দেওয়া বোঝা। শিক্ষার্থী তাই বৈচিত্রপূর্ণ পরিবেশে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী শিক্ষাগ্রহণ করে।

3. সৃজনশীলতা:- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সৃজনশীলতা। প্রতিটি শিক্ষার্থীর মৌলিকতা, সৃজনশীলতা জন্ম সূত্রে প্রাপ্ত এবং সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশুর এই মৌলিকতা ও সৃজনশীলতা প্রকাশকরনের জন্য বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

4. শিক্ষকের ভূমিকা:- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা হল-শিক্ষার্থীর বন্ধু, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শক (Friend, Philosopher and Guider)অর্থাৎ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনমতো পরামর্শতার ভূমিকা পালন করবেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন সম্ভবপর হবে।

5. মুক্ত শৃঙ্খলা:- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মুক্তশৃঙ্খলা। শিশুকে ভয় দেখিয়ে বা জোর করে শৃঙ্খলা স্থাপন করা যাবে না। তাহলে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হবে। তাই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশুকে মুক্ত শৃঙ্খলার মাধ্যমে শিক্ষাদান করার কথা বলা হয়েছে।

6. মনোবিদ্যার আদর্শ প্রয়োগ:- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মনোবিদ্যার পরীক্ষামূলক তত্ত্ব এবং নীতিগুলি প্রয়োগ করা হয়। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার পদ্ধতিতে যুক্তির থেকে মনস্তত্ত্বের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশু শ্রেণীকক্ষে নিষ্ক্রিয় শ্রোতা নয়। সে শিখন প্রক্রিয়ায় একজন অংশগ্রহণকারী। আধুনিক শিশুশিক্ষা পদ্ধতি শিশুর আগ্রহ সৃষ্টি করে। তার মধ্যে প্রেষণার উন্মেষ ঘটায় এবং তার সক্রিয়তাকে উদ্দীপিত করে। শিশু নিজেকে কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চায়। খেলা তার কাছে আনন্দমূলক, স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রক্রিয়া। সুতরাং খেলা হবে শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি।

7. ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা:- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা। প্রতিটি শিক্ষার্থী নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বর্তমান আছে। আর ওই ব্যক্তির ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার ওপর ভিত্তি করে শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষা রচিত হয়েছে। অর্থাৎ এখানে শিশুর চাহিদা আগ্রহ প্রবণতা করা হয়েছে।

8. অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা:- এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার পাঠক্রম পুথিগত, বিমুর্ত এবং পুস্তক কেন্দ্রিক নয়। শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ এর কার্যাবলী এবং বৈচিত্রপূর্ণ জীবন অভিজ্ঞতা সম্মুখে কেন্দ্র করে শিক্ষার বিষয় নির্দিষ্ট হয়।

9. ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে:- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশের পাশাপাশি তার শারীরিক, প্রাক্ষোভিক, সামাজিক ও নৈতিক দিকগুলির সুষম বিকাশের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটে।

10. জীবনকেন্দ্রিক শিখন পদ্ধতি গড়ে তুলতে সাহায্য করে:- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার মূল ধারণা গ্রহণ করে বর্তমানে সারা বিশ্বে শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশের লক্ষ্য গড়ে উঠেছে নানারূপ শিক্ষণ পদ্ধতি। যেমন- অনুশিক্ষণ, বৌদ্ধিক পদ্ধতি, উৎপাদনশীল চিন্তন পদ্ধতি, মিথস্ক্রিয়ামূলক বিশ্লেষণ পদ্ধতি ইত্যাদি। এই শিক্ষণ পদ্ধতির দ্বারা শিক্ষার্থীর জীবনকে সর্বাঙ্গীণভাবে গড়ে তোলা হয়।

11. শিক্ষার্থীকে সুনাগরিক তৈরি করে:- এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহ অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তোলে। ফলে সে সুবিধা-অসুবিধা, ন্যায়-অন্যায় আচরণ গুলি এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে আদর্শ নাগরিক রূপে তৈরি করতে পারে।

12. বিদ্যালয়ের ভূমিকা:- সবশেষ শিক্ষায় বিদ্যালয়ের নতুন ভূমিকা উল্লেখ করতে হয়। আধুনিক বিদ্যালয় জ্ঞানের দোকান বা পন্ডিত তৈরির কারখানা নয়। এটি শিক্ষার্থীর কাছে চার দেয়ালে আবদ্ধ জেলখানাও নয়। বিদ্যালয় গৃহের মতো এক স্বাভাবিক স্থান যেখানে, শিক্ষার্থীরা বাস করে এবং কাজ করে। এটি হলো শিশুর সামাজিক আবাস, জীবন নাটকের মঞ্চ যা শিক্ষার্থীকে আগামী দিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ক্রমশ সক্ষম করে তোলে।

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার তাৎপর্য (Feature of Child Centric Education):

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার তাৎপর্য যে সমস্ত দিক থেকে বর্তমান সেগুলি হলো নিম্নলিখিত:-

1. সামগ্রিক বিকাশ:-শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা শিশুর সামগ্রিক বিকাশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। এই শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, প্রাক্ষোভিক, আধ্যাত্মিক প্রভৃতি দিকের বিকাশ ঘটানো হয়। তার শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।

2. মনোবিজ্ঞান দৃষ্টিভঙ্গি:- মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। শিশুর বিকাশে সমাজের গুরুত্ব স্বীকার করলেও মনোবিজ্ঞান ব্যক্তি শিশুকে আগে স্মরণ করে। শিশু শিক্ষার দর্শন একই কথা বলে। এছাড়া মনোবিজ্ঞান শিশুর বিভিন্ন দিকের বিকাশ, স্মৃতি, বুদ্ধি, মনোযোগ, শিখন সম্পর্কে মূল্যবান তত্ত্ব বা তথ্য সরবরাহ করে।মনোবিজ্ঞান শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাকে আরও উন্নত করে তোলে সাহায্য করে।

3. সক্রিয়তা ও কল্পনা শক্তির বিকাশ:- জীববিদ্যা শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় নানা প্রকার খেলা, বালি মাটি দিয়ে বাড়ি তৈরি করা, অংকন, শিল্পকর্ম ইত্যাদি কে পূর্ণ সমর্থন করে। এইসব খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শিশুরা আমাদের পূর্বপুরুষদের আচরণ পুনরাবৃত্তি করে। তাদের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে।

4. স্বতন্ত্র শিখন:- প্রতিটি শিশুর একটি অনন্য শেখার ধরন এবং বোঝার স্তর রয়েছে। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা শিক্ষকদের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর চাহিদা পূরণের জন্য তাদের শিক্ষার পদ্ধতিগুলিকে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে।যাতে কোনো শিক্ষার্থী পিছিয়ে না থাকে তার নিশ্চিত করে। তাই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশুর স্বতন্ত্র শিখনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। এদিক থেকে এটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।

5. সমালোচনামূলক চিন্তা ভাবনা এবং সমস্যা সমাধান:- শিশুকেন্দ্রিক শ্রেণিকক্ষে, শিক্ষার্থীদের প্রায়শই অন্বেষণ, সন্ধান এবং বাস্তব বিশ্বের সমস্যা সমাধানের সুযোগ থাকে। এটি সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতা বৃদ্ধি করে এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে। তাই বলা যায় সমালোচনা মূলক চিন্তাভাবনা এবং সমস্যার সমাধান করার ক্ষেত্রে শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষার তাৎপর্য অনস্বীকার্য।

6. বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা:- প্রতিটি শিশুই ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং দৃষ্টিভঙ্গিসহ একটি অনন্য পরিবেশ থেকে আসে। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা এই বৈচিত্র্যকে মূল্য দেয় বা বৈচিত্রের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। ফলে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ গড়ে তোলে এখানে শিক্ষার্থীরা একে অপরের সংস্কৃতি ও দৃষ্টিকোণ থেকে শিখে।

7. ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি:- বিশ্ব দ্রুত বিকশিত হচ্ছে ও সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাও সততা পরিবর্তিত হচ্ছে। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, যোগাযোগ, সহযোগিতা এবং সমালোচনা মূলক চিন্তার মতো দক্ষতার ওপর জোর দেয়, যা আধুনিক কর্মশক্তিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুকে ভবিষ্যতের জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি তাৎপর্য হয়েছে।।

8. মানসিক সুস্থতা:- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা মানসিক সুস্থতার গুরুত্ব স্বীকার করে। এটি একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে যেখানে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ বোধ করে, যা তাদের মানসিক বিকাশে সাহায্য করে। তাই মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

9. জীবনব্যাপী শিক্ষা:- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা জীবনব্যাপী শিক্ষার ভিত্তি তৈরি করে। দাপ্প করতে শিক্ষা হলো কতদিন বাঁচি ততদিন শিখি। তাই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা হলো জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। এর মধ্য দিয়ে শিশুরা সারা জীবনব্যাপী জ্ঞান অর্জন করবে বা শিক্ষা অর্জন করবে।

10. ইতিবাচক শিক্ষক ছাত্র সম্পর্ক:- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের তাদের শিক্ষার্থীদের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। এই সম্পর্কটি যোগাযোগ, বিশ্বাস এবং বোঝাপড়ার উন্নতি ঘটায়। অর্থাৎ প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থার মতো শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা শিক্ষক কেন্দ্রিক নয়। বরং এই শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষার ইতিবাচক ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক তৈরি হয়।

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার বাধা সমূহ (Constraints of Child Centric Education):

আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুর সর্বাঙ্গির বিকাশের জন্য শিক্ষাবিদগণ শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার পাঠক্রম, শিক্ষার ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষার সুযোগ সাপেক্ষে শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষা প্রকৃত অর্থে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। তাই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা বা বাধা সমূহ আমাদের শিক্ষার সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের জানা অবশ্যই প্রয়োজন। এগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

1. পরিবারের ভূমিকা:- অধিকাংশ শিশুর পরিবারের বয়স্কদের নির্দেশ মেনে চলতে হয়, তাই প্রথম থেকেই শিশুর নিজস্ব ইচ্ছা ও মত প্রকাশের সুযোগ বাধা পায়।

2. পিতা-মাতার সুপ্ত ইচ্ছা:- অনেক পিতা-মাতা ব্যক্তিগত জীবনের সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। তাই শিশু সন্তানের ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে তারা নিজের ইচ্ছাকে সন্তানের উপর চাপিয়ে দেন।

3. স্বাধীনতার মাত্রা:- শিশুর স্বাধীনতা শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু স্বাধীনতাকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবহার করে আজকের শিশু স্বৈরাচারী, অবাধ্য হয়ে উঠেছে।

4. নিজস্ব যোগ্যতা:- নিজের যোগ্যতাকে বিচার না করেই আজকের শিশু প্রায়শই নিজের ইচ্ছামত শিক্ষা গ্রহণ করছে। ফলে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিচ্ছে।

5. সুযোগের অভাব:- আজকের প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থায়ী উপযুক্ত সুযোগের অভাবে অনেক শিশুর যোগ্যতা অনুসারে সাফল্য লাভ করতে পারে না।

6. ব্যবস্থাপনার অভাব:- যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা না থাকার জন্য অনেক কিছুই নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পড়াশোনা বা বৃত্তিগত দিকে সাফল্য লাভ করতে পারে না।

7. অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা:- পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অসুবিধার কারণ।

8. তথ্যের অভাব:- আজকের বহুমুখী শিক্ষার বিভিন্ন দিকগুলি শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে জানতে না পারার জন্য তারা সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে না।

9. পরীক্ষা ব্যবস্থা:- বর্তমানে অবৈজ্ঞানিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর মুখস্ত বিদ্যা পরিমাপ হচ্ছে। ক্ষমতার মূল্যায়ন হচ্ছে না। ফলে শিশুর ক্ষমতার সদব্যবহার হচ্ছে না।

আধুনিক শিক্ষায় শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রভাব (Impact of Child Centric Education on Modern Education)

আধুনিক শিক্ষার সমস্ত দিকই শিশুকেন্দ্রিক। কুইন্টিলিয়ান ও রুশো এবং বাইরে থেকে ফ্রয়েবেল সকলেই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষার প্রথম পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের মূলকথা হলো, শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য গুলি কে আবিষ্কার করাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য এবং শিশুর আত্মসক্রিয়তাই শিক্ষার মূল ভিত্তি।

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা আধুনিক শিক্ষাকে নিম্নলিখিতভাবে প্রভাবিত করেছে:-

1. শিশু হলো শিক্ষার প্রধান উপাদান। শিক্ষাই জীবন। সুতরাং মানব শিশুর জীবন বিকাশের প্রক্রিয়ায় হলো শিক্ষা। জীবন পরিবেশে সার্থক অভিযোজন ঘটাতে শিক্ষা অপরিহার্য প্রক্রিয়া।

2. শিক্ষার লক্ষ্য নির্ণয়ে শিশুর চাহিদাকে প্রথমেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আধুনিক মনোবিদ ও শিক্ষা মনোবিদগণ মনে করেন ব্যক্তি শিশুর চাহিদা পূরণ শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত।

3. শিশুর দৈহিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক, সামাজিক, নৈতিক, চারিত্রিক প্রভৃতি দিকের বিকাশসাধনই শিক্ষার লক্ষ্য। সুতরাং শিক্ষার সার্বিক লক্ষ্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে শিশুর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা গুলির ওপর গুরুত্ব আরোপ শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষার একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক। আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞান একই কথা বলে।

4. শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশুকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়। জোর করে কোন বোঝা তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় না। আধুনিক শিক্ষায় শিশুর স্বাধীনতাকে উৎসাহ দেয়া হয়। শিশু তার পছন্দ অনুযায়ী পাঠ্যক্রম গ্রহণের সুযোগ পায়।

5. সক্রিয়তাভিত্তিক শিক্ষাই হলো আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুর সক্রিয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

6. আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষক বন্ধু এবং সহায়ক এর ভূমিকা পালন করেন। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায়ও শিক্ষার্থীর সক্রিয়তার মাধ্যমে শেখে এবং শিক্ষক তাকে সাহায্য করেন।

7. শিক্ষার্থীর সৃজন ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো আধুনিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য, যা শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রধানতম শর্ত।

8. শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলার কথা বলা হয় যা আধুনিক শিক্ষা মনোবিদ্যা সুপারিশ করে।

9. শিখায় সামাজিক লক্ষ্যের দৃষ্টিতে শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষায় বিভিন্ন মানবীয় সম্পর্কের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন- শিক্ষার্থী-শিক্ষকের সম্পর্ক, শিক্ষার্থী-শিক্ষার্থী সম্পর্ক, এবং শিক্ষক-সমাজ সম্পর্কে।

উপসংহার:

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা, শিক্ষা ক্ষেত্রে যে বিপ্লব সূচনা করেছে তাই নয়, আধুনিক শিক্ষার জন্ম দিয়েছে।

 

   ⇐নীচে pdf টির লিংক শেয়ার করা হল⇒

  • File Name:- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা
  • No.of Page:- 8
  • Location:- Google Drive 
  • Download Link:- [Download]

 

Leave a comment