Natural Vegetation of India||স্বাভাবিক উদ্ভিদের শ্রেণীবিভাগ ও বৈশিষ্ট্য

Natural Vegetation of India||স্বাভাবিক উদ্ভিদের শ্রেণীবিভাগ ও বৈশিষ্ট্য

Natural Vegetation of India

ভারতের স্বাভাবিক উদ্ভিদ:

উপযুক্ত জলবায়ু, ভূপ্রকৃতি ও মৃত্তিকা প্রভাবিত অঞ্চলে মানুষের পরিচর্যা ছাড়া জন্মানো ও বেড়ে ওঠা উদ্ভিদগুলিকে স্বাভাবিক উদ্ভিদ বলে।

ভারতের স্বাভাবিক উদ্ভিদের গুরুত্ব:

1. স্বাভাবিক উদ্ভিদ বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে, অক্সিজেন সরবরাহ করে।

2. বায়ুতে জলীয় বাষ্প সংযোজন করে।

3. বায়ুমন্ডলে জীব বসবাসের উপযোগী তাপমাত্রা বজায় রাখে।

4. বহু জীবের বাসস্থল।

ভারতের স্বাভাবিক উদ্ভিদের প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য:

এইচ. জি. চ্যাম্পিয়ন ভারতের ১১৬ রকমের স্বাভাবিক উদ্ভিদ খুঁজে পেয়েছেন। এই শ্রেণীবিভাগ থেকে আরও সহজ করে দেখান জি.এস.পুরি, লেগ্ৰিস, নেগি প্রমুখ বিজ্ঞানীগণ। এই বিশেষজ্ঞদের শ্রেণীবিভাগ এর উপর নির্ভর করে ভারতের স্বাভাবিক উদ্ভিদ কে প্রধান ৫ টি ভাগে ও ১৬ টি উপবিভাগে ভাগ করা যায় যথা-

1. ক্রান্তীয় চিরহরিৎ অরণ্য:

প্রাকৃতিক পরিবেশ: ভারতের যে সকল অঞ্চলের বার্ষিক বৃষ্টিপাত ২০০ সেমির বেশি, গড় উষ্ণতা ২৫°-২৭° সেঃ, বছরে ৮-৯ মাস বাতাসের আর্দ্রতা থাকে বেশি (৮০%), সেখানে এই ধরনের উদ্ভিদ জন্মায়। অত্যাধিক উষ্ণতা ও আদ্রতার কারণে এ ধরনের গাছের পাতা গুলি একসঙ্গে ঝরে পড়ে না। এই বনভূমি চিরসবুজ, তাই এর নাম চিরহরিৎ অরণ্য।

উদ্ভিদ: রবার, এবনি, তুন, পুন, রোজউড, আয়রন উড, শিশু, বেত, বাঁশ, ফার্ন, অর্কিড ইত্যাদি এই অরণ্যের প্রধান উদ্ভিদ।

আঞ্চলিক বন্টন: আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিমঢাল, অরুণাচল প্রদেশ, উচ্চ অসম, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, মিজোরাম এবং ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যে ক্রান্তীয় চিরহরিৎ অরণ্য দেখা যায়। ভারতের ভূমিভাগের প্রায় ১২% অঞ্চল ক্রান্তীয় চিরহরিৎ অরণ্যে আবৃত।

বৈশিষ্ট্য: ১)এই অরনের উদ্ভিদগুলি চিরসবুজ। ২)উদ্ভিদ গুলির ঘনত্ব খুব বেশি। ৩) এগুলি বেশি দীর্ঘ ও বহু স্তর বিশিষ্ট। ৪) গাছগুলি ডালপালা পরস্পর যুক্ত হয়ে চাঁদোয়ার আকার ধারণ করে। ফলে মাটির ওপর সূর্যের আলো এসে পৌঁছতে পারে না। ৫) এই অরণ্যে বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ একই সঙ্গে জন্মায়। ৬) উদ্ভিদগুলির উচ্চতা গড়ে ৩৫-৪৫ মিটার, কখনো কখনো ৬০ মিটার উঁচুও হয়ে থাকে। ৭) বনভূমির তলদেশ লতাগুল্মে আবৃত থাকে। ৮) উদ্ভিদ গুলি সাধারণত বৃহৎ পত্রযুক্ত হয়।

ব্যবহার: ১) আবলুস, মেহগনি, সেগুন, আয়রন উড ইত্যাদি গাছের কাঠ খুব শক্ত ও মজবুত হয় রেলের স্লিপার, জাহাজের পাঠাতন, আসবাবপত্র তৈরিতে কাজে লাগে। ২) এই বনভূমির অন্যান্য গাছের কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ৩) তাছাড়া, বনজ সম্পদ হিসেবে পাতা, শিকড়, আঠা বা রস, ফল ইত্যাদিও ব্যবহৃত হয়।

2. ক্রান্তীয় আর্দ্র পর্ণমোচী অরণ্য:

প্রাকৃতিক পরিবেশ: ভারতের যে সকল অঞ্চলের বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১০০-২০০ সেমি এবং বৃষ্টিপাতের বেশিরভাগই হয় বর্ষাকালে, গ্রীষ্মকালের গড় উষ্ণতা থাকে ২৭°-৩০° সেঃ ও শীতকালে ১৫°-২০° সেঃ এবং আর্দ্রতা থাকে ৬০-৭৫%, শীতকাল- শুষ্ক থাকে, সেখানে এই ধরনের উদ্ভিদ জন্মায়।

উদ্ভিদ: শাল, সেগুন, আম, জাম, বট, অশ্বত্থ, নাম, জারুল, শিরীষ, চন্দন, পলাশ, মহুয়া প্রভৃতি এই অরণ্যের উল্লেখযোগ উদ্ভিদ।

আঞ্চলিক বন্টন: পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পশ্চিম ঢালে, তরাই ও ভাবর সহ শিবালিক পার্বত্য অঞ্চলে, মনিপুর, মিজোরাম, মধ্যপ্রদেশের পূর্বাংশে, ছোটোনাগপুর মালভূমি, ওড়িশা, আন্দামান ও নিকোবর দীপপুঞ্জের কিছু অংশে এবং পশ্চিমবঙ্গের সমভূমিতে এই অরণ্য দেখা যায়।

বৈশিষ্ট্য: ১) গাছগুলি শীতের আগে পাতা ঝরিয়ে ফেলে‌ এবং বর্ষাকালে নতুন পাতায় ভরে যায়। বছরের নির্দিষ্ট ঋতুতে পাতা ঝরে যায় বলে এই সকল উদ্ভিদকে পর্ণমোচী উদ্ভিদ বলে। ২) এই অঞ্চলে একই প্রজাতির উদ্ভিদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ৩) উদ্ভিদ গুলির ঘনত্ব বেশ কম। ৪) গাছগুলির উচ্চতা ২৫-৬০ মিটার। ৫) গাছগুলির নির্দিষ্ট কোন আকৃতি নেই। এরা এলোমেলোভাবে বেড়ে ওঠে।

ব্যবহার: ১) পর্ণমোচী অরণ্যের কাঠ থেকে আসবাবপত্র, বাড়িঘর, রেলের কামরা ও স্লিপার, নৌকা ও জাহাজের পাটাতন ইত্যাদি তৈরি করা হয়। ২) বাঁশ ও সাবাই ঘাস কাগজ শিল্পের কাঁচামাল। ৩) তুঁতগাছ গুটি পোকার খাদ্য। এই অরণ্যের তুঁতগাছ প্রচুর জন্মায়, যা থেকে রেশম গুটি সংগ্রহ করা হয়।

3. মরু উদ্ভিদ:

মরু উদ্ভিদ মরুদ্যান বা যেখানে জলের সন্ধান পাওয়া যায়, সেখানেই জন্মায়। প্রকৃত মরু অঞ্চল রুক্ষ ও শুষ্ক। তাই সেখানে উদ্ভিদের পরিমাণ খুবই কম। মরু উদ্ভিদকে জাঙ্গল উদ্ভিদ বা জেরোফাইট বলে।

প্রাকৃতিক পরিবেশ: ২৫ সেমির কম গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত, অত্যাধিক উষ্ণতা (৩০°-৩৫°) সেঃ এবং খুব কম আর্দ্রতা যুক্ত অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে দু একটা উদ্ভিদ জন্মালেও বেশিরভাগ অঞ্চলে বৃক্ষহীন মরুভূমি রূপে বিরাজ করে।

আঞ্চলিক বন্টন: রাজস্থানের মরু অঞ্চলে, গুজরাট ও পাঞ্জাবের মরু অঞ্চলে এই ধরনের উদ্ভিদ জন্মায়।

উদ্ভিদ: ফনিমনসা, বাবলা, ক্যাকটাস, খেজুর, বিভিন্ন ঘাস ও কাঁটাঝোপ এখানকার প্রধান উদ্ভিদ।

বৈশিষ্ট্য: ১) উদ্ভিদ গুলি ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠে। ২) জলের সন্ধানে শিকড় মাটির অনেকটা গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ৩) উদ্ভিদের পাতা সরু ও পুরো মোমের প্রলেপ যুক্ত হয় কিছু ক্ষেত্রে পাতা গুলি কাঁটায় পরিণত হয়। ৪) উদ্ভিদ গুলি খর্বাকৃতি হয়।

ব্যবহার: বাবলা গাছের কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

4. ম্যানগ্রোভ অরণ্য:

প্রাকৃতিক পরিবেশ: সূক্ষ্ম পলিমাটি, জোয়ার ভাটার প্রভাব যুক্ত ভারতের উপকূল ও ব-দ্বীপ অঞ্চল সমূহে এই অরণ্য দেখা যায়।

উদ্ভিদ: সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া, হেঁতাল, গোলপাতা, হোগলা, কেয়া, কেওড়া ইত্যাদি এই অরণ্যের প্রধান উদ্ভিদ।

আঞ্চলিক বন্টন: গঙ্গা বদ্বীপের সুন্দরবন, মহানদী (ভিতরকণিকা), গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী বদ্বীপ ও তৎসংলগ্ন উপকূল এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এই ধরনের উদ্ভিদ জন্মায়।

বৈশিষ্ট্য: ১) জোয়ার ভাটার প্রভাবে এই অরণ্যের মৃত্তিকা সর্বদা ভিজে থাকে। তাই উদ্ভিদ গুলির প্রকৃতি চিরহরিৎ। ২) এখানকার মৃত্তিকার শারীরবৃত্তি ও শুষ্ক মৃত্তিকা হওয়ায় শ্বাসকার্য চালানোর জন্য উদ্ভিদের মূলগুলি মাটি ফুঁড়ে উপর দিকে উঠে আসে। এই মূল গুলি বায়ু থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে। এগুলিকে শ্বাসমূল বলে। ৩) জোয়ার ভাটার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এদের ঠেসমূল থাকে। ৪) উদ্ভিদ গুলির জরায়ুজ অঙ্কুরোদগম ঘটে। অর্থাৎ গাছের ফল বা বীজ জলে পড়ে যাতে নষ্ট না হয় বা ভেসে অন্যত্র চলে না যায়, সেজন্য ফলগুলি মাটিতে পড়ার আগেই গাছে থাকাকালীনই অঙ্কুরিত হয়। ৫) গাছগুলির উচ্চতা কম হয়।

ব্যবহার: ১) ম্যানগ্রোভ অরণ্যের কাঠ সাধারণত নৌকা ও বাড়িঘর তৈরি করতে এবং জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ২) এছাড়াও, বনভূমি থেকে মোম, মধু ও ঔষধি গাছ প্রভৃতি পাওয়া যায়। ৩) হোগলা, গোলপাতা দিয়ে বাড়ির ছাউনি, মাদুর, ঝুড়ি ইত্যাদি তৈরি হয়। এছাড়া সুন্দরবনে রয়েছে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

5. পার্বত্য উদ্ভিদ:

প্রাকৃতিক পরিবেশ: হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন উচ্চতায় উষ্ণতার পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ জন্মায়। প্রকৃতপক্ষে, হিমালয়ের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে উদ্ভিদের বিভিন্ন জন্য দায়ী জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যের বিভিন্নতা।

ক) চিরহরিৎ অরণ্য: পূর্ব হিমালয়ের ১০০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত অধিক বৃষ্টিপাত ও উষ্ণতার কারণে শাল, শিশু, গর্জন প্রভৃতি চিরহরিৎ অরণ্য গড়ে উঠেছে। পশ্চিম হিমালয়ে ৫০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত দু একটি স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে এই অরণ্য গড়ে উঠেছে। খ)পাইন অরণ্য: পশ্চিম হিমালয়ের ১০০০-২০০০ এম উচ্চতায় ও পূর্ব হিমালয়ের একই উচ্চতায় দু একটি স্থানে এই ধরনের বনভূমি দেখা যায়। গ)মিশ্র অরণ্য: পূর্ব হিমালয়ের ১০০০-৩০০০ মিটার উচ্চতায় ও পশ্চিম হিমালয়ের ১৫০০-২৫০০ মিটার উচ্চতায় দেবদারু, ওক, বার্চ, ম্যাপল নাতিশীতোষ্ণ পর্ণমোচী ও নাতিশীতোষ্ণ চিরহরিৎ অরণ্যের সংমিশ্রণ দেখা যায়। ঘ) সরলবর্গীয় অরণ্য: পূর্ব হিমালয়ের ৩০০০-৪০০০ মিটার উচ্চতায় দেবদারু, ফার, স্প্রুস, উইলো ইত্যাদি সরলবর্গীয় উদ্ভিদ জন্মায়। ঙ) আল্পীয় অরণ্য: সরলবর্গীয় অরণ্যের ঊর্ধ্বে যে স্থান বছরে ৩-৪ মাস বরফে ঢাকা ও বাকি সময় বরফমুক্ত থাকে, সেখানে জুনিপার, রডোডেনড্রন ও ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ জন্মায়।

ব্যবহার: এই বনভূমির কাঠ প্যাকিং বাক্স, কাগজ, আসবাবপত্র ইত্যাদি তৈরিতে কাজে লাগে। নানা মূল্যবান গাছ থেকে ওষুধ তৈরি করা হয়। তবে দুর্গম ও এবড়োখেবড়ো ভুভাগ, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, শ্রমিকের অভাব ইত্যাদির কারণে এখানকার বনভূমির বাণিজ্যিক ব্যবহার খুব কম।

 

Leave a comment